হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা এবং হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর প্রধান সাহাবীদের অন্যতম। আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় খলীফা হিসেবে দায়িত্ব নেন। উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইসলামী আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ ছিলেন। ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে আল-ফারুক বা সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী উপাধি দেওয়া হয়। আমীরুল মু’মিনীন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসে তাকে প্রথম উমর হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। সাহাবীদের মর্যাদার ক্ষেত্রে আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পর উমরের অবস্থান। এছাড়াও তিনি ছিলেন মুহাম্মদ (সা:) এর শ্বশুর অর্থাৎ ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মেয়ে হাফসা ছিলেন আখেরী নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী।
উমর মক্কার কুরাইশ বংশের বনু আদি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম খাত্তাব ইবনে নুফায়েল এবং মায়ের নাম হানতামা বিনতে হিশাম। তার মা বনু মাখজুম গোত্রের সদস্য ছিলেন। যৌবনে তিনি মক্কার নিকটে তার বাবার উট চরাতেন। তরুণ বয়সে উমর লিখতে ও পড়তে শেখেন। নিজে কবি না হলেও কাব্য ও সাহিত্যের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। কুরাইশ ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি তার কৈশোরে সমরবিদ্যা, অশ্বারোহণ ও কুস্তি শেখেন। তিনি দীর্ঘদেহী ও শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলেন। কুস্তিগির হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। এছাড়াও তিনি একজন সুবক্তা ছিলেন। তার বাবার পরে তিনি তার গোত্রের একজন বিরোধ মীমাংসাকারী হন।
৬১০ সালে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা:) ইসলাম প্রচার শুরু করেন। অন্যান্য মক্কাবাসীর মতো উমর প্রথম পর্যায়ে ইসলামের বিরোধিতা করেছিলেন। উমর ৬১৬ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর উমর মুসলিমদের সবচেয়ে কঠোর প্রতিপক্ষ আবু জেহেলকে তা জানান। উমরের ইসলাম গ্রহণের পর প্রকাশ্যে কাবার সামনে নামাজ আদায় করতে মুসলিমরা বাধার সম্মুখীন হয়নি। ইসলাম গ্রহণের পর গোপনীয়তা পরিহার করে প্রকাশ্যে তিনি মুসলিমদের নিয়ে বাইরে আসেন এবং কাবা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। তিনি ছাড়াও হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন। সেদিন নবী মুহাম্মদ তাকে “ফারুক” উপাধি দেন।
মক্কায় নির্যাতনের কারণে এবং মদিনা থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আসায় মুসলিমরা মদিনায় হিজরত করতে থাকে। অধিকাংশ ব্যক্তিই ধরা পড়ার ভয়ে রাতে হিজরত করতেন। কিন্তু উমর দিনের বেলায় বিশজন সাহাবীসহ প্রকাশ্যে হিজরত করেন। ৬২৪ সালে উমর বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৬২৫ সালে তিনি উহুদের যুদ্ধেও অংশ নেন। পরবর্তীতে তিনি বনু নাদির গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযানেও অংশ নিয়েছেন। ৬২৫ সালে মুহাম্মদ (সা:) এর সাথে উমরের মেয়ে হাফসা বিনতে উমরের বিয়ে হয়। ৬২৭ সালে তিনি খন্দকের যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী বনু কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন।
৬২৮ সালে তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধিতে অংশ নেন এবং সাক্ষ্য হিসেবে এতে স্বাক্ষর করেন। ৬২৮ সালে উমর খায়বারের যুদ্ধে অংশ নেন। ৬৩০ সালে মক্কা বিজয়ের সময় উমর এতে অংশ নেন। পরে হুনায়নের যুদ্ধ এবং তাইফ অবরোধে তিনি অংশ নিয়েছেন। তাবুকের যুদ্ধে সাহায্য হিসেবে তিনি তার সম্পদের অর্ধেক দান করে দিয়েছিলেন। বিদায় হজ্জেও তিনি অংশ নিয়েছেন। মুহাম্মদ (সা:) এর মৃত্যুর পর খিলাফতের প্রতিষ্ঠায় উমর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। হযরত আবু বকরকে খলিফা হিসেবে অধিক যোগ্য বলে দাবি করে তার প্রতি উমর আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেয়। ইসলামী খিলাফতের প্রতিষ্ঠায় উমরের সবচেয়ে অবদান ছিল অত্যৗল্প গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর ইতিহাসেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
আবু বকরের শাসনামলে উমর তার একজন প্রধান সচিব ও উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত ¡পালন করেছেন। ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফিজ শহিদ হলে উমর কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলনের জন্য আবু বকরের কাছে আবেদন জানান। এর ফলে কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়। আবু বকর মৃত্যুর পূর্বে উমরকে তার উত্তরসূরী নিয়োগ দিয়ে যান। উমর তার ইচ্ছাশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক সচেতনতা, নিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার এবং দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি সদয আচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন। উত্তরসূরী হিসেবে উমরের ক্ষমতা ও সক্ষমতা সম্পর্কে আবু বকর অবগত ছিলেন। মৃত্যূর পূর্বে আবু বকর উমরকে ডেকে তার অসিয়ত লিখতে বলেন যাতে তিনি উমরকে নিজের উত্তরসূরী ঘোষণা করে যান। অসিয়তনামায় উমরকে ইরাক ও সিরিয়া জয়ের অভিযান চালু রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
ক্ষমতাপ্রাপ্তি পর সকল মুসলিম তাকে বায়াত প্রদান করেন। শাসক হিসেবে উমর দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। রিদ্দার যুদ্ধে কয়েক হাজার বিদ্রোহী ও ধর্মত্যাগীকে দাস হিসেবে বন্দী করা হয়েছিল। উমর এসকল বন্দীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তাদের মুক্তির নির্দেশ দেন। এই ঘোষণা বেদুইন গোত্রগুলোর কাছে উমরের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিল। উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সময় উনার সরকার এককেন্দ্রীক ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। এতে খলিফা ছিলেন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ।
পুরো সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। পাশাপাশি আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া এসব অঞ্চলের কিছু স্বায়ত্তশাসিত এলাকা খিলাফতের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়। প্রদেশগুলো প্রাদেশিক গভর্নর বা ওয়ালি কর্তৃক শাসিত হত। উমর ব্যক্তিগতভাবে ওয়ালিদের নিযুক্ত করতেন। প্রদেশগুলোকে বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত করা হত। পুরো সাম্রাজ্যে প্রায় ১০০ এর মতো জেলা ছিল। প্রতিটি জেলা বা প্রধান শহর একজন অধস্তন গভর্নর বা আমিলের দায়িত্বে থাকত। আমিলরা সাধারণত উমর কর্তৃক নিযোগপ্রাপ্ত হতেন তবে প্রাদেশিক গভর্নররাও তাদের নিয়োগ দিতে পারতেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওয়ালিগণ প্রদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্মরত থাকলেও কিছু প্রদেশে পৃথক সামরিক অফিসার থাকত। প্রতিটি নিয়োগ লিখিত আকারে দেওয়া হত। নিয়োগের সময় গভর্নরদের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হত। দায়িত্বগ্রহণের পর গভর্নররা জনতাকে প্রধান মসজিদে জড়ো করে তাদের সামনে নির্দেশনা পড়ে শোনাতেন। এছাড়াও আরো কিছু বিধিনিষেধ গভর্নর ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উপর জারি করা হয়। প্রধান কর্মকর্তাদেরকে হজ্জের সময় মক্কায় আসতে হত এবং এসময় জনগণ তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ তুলতে পারত।
রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য উমর সর্বপ্রথম বিশেষ বিভাগ গঠন করেন। এই বিভাগ প্রশাসনিক আদালত হিসেবে কাজ করত এবং এর আইনি কর্মকান্ড উমর ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post